গার্মেন্টস শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন
এখানেই থামবেন না
            
            
            
            গার্মেন্টস শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন
এখানেই থামবেন না
আন্দোলন প্রতিবেদন
বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ | অনলাইন সংস্করণ
চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের জুন মাস থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নামেন। তারা স্পষ্ট দাবি তুলেছিলেন ‘হয় দাম কমাও, নয়তো মজুরি বাড়াও’। ন্যূনতম মজুরি ৮,০০০ টাকায় এক পরিবারের দুইজনের আয়েও চলতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখনই তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি ২৩/২৫ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলেই এ বছর এপ্রিলে সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ছয় মাসেও মজুরি বোর্ড কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায় শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভ জমতে থাকে। মেয়াদহীন মজুরি বোর্ড ২২ অক্টোবর মালিকদের স্বার্থে ন্যূনতম মজুরি মাত্র ১০,৪০০ টাকা প্রস্তাব করলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন।
শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুঁড়ে শ্রমিক আন্দোলন ছত্র-ভঙ্গ করে। পুলিশ গুলি করে শ্রমিক হত্যা করলে শ্রমিক আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, মিরপুরসহ অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্রমিক আন্দোলন থামাতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে/পরামর্শে ৭ নভেম্বর’২৩ মজুরি বোর্ড ন্যূনতম মজুরি মাত্র ১২,৫০০ টাকা চূড়ান্ত করলে শ্রমিকরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গী আন্দোলন শুরু করেন। কাজ বন্ধ রেখে কারখানার সামনে বা মহাসড়কে জড়ো হয়ে ৪/৫ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ ও আন্দোলন চালাতে থাকেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-নির্যাতনে এবং শ্রমিক নেতা নামধারী সরকারি দালালদের ষড়যন্ত্রে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসলেও প্রস্তাবিত মজুরি শ্রমিকরা মেনে নেননি।
আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ‘গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ সহ ১১ সংগঠনের জোট "মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন" ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা প্রত্যাখ্যান করে। এই জোট ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে আঞ্চলিক সমাবেশ, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন অব্যাহত রেখেছে। শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে শ্রমিক ইমরান, রাসেল, আঞ্জুয়ারা বেগম ও জামালকে হত্যা করেছে। বিজিবি-র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করে শ্রমিক এলাকাগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। শ্রমিক এলাকার প্রতিটি চায়ের টং-দোকান বন্ধ করে, চার/পাঁচ জন জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ করে মূলত কারফিউ জারি করে। ৪৩ মামলায় ২০ হাজার শ্রমিককে আসামী করে শ্রমিক নেতা বাবুল হোসেনসহ এ পর্যন্ত ১১৫ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করে। শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করতে মালিক পক্ষের আওয়ামী গুন্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শ্রমিক নেতাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মালিকরা ১৩৬টি কারখানা বন্ধ করেছিলো। এখন শ্রমিক নেতাদের ছাঁটাই করতে কালো তালিকা প্রস্তুত করছে।
৪ জন শ্রমিক হত্যা ও অগণিত জখমের দায় কার?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দাবিকৃত মজুরির অর্ধেকে সন্তুষ্ট থেকে কাজে ফিরে যাওয়ার নসিহত করেছে। হুমকি দিয়ে বলেছে আন্দোলন বন্ধ না করলে শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে কোনো মহলের উস্কানি বলে আখ্যায়িত করে বলেছে যারা তোমাদের উস্কানি দিবে তারাই তোমাদের লাশ ফেলে দিবে। (যেমনটা আওয়ামী গুণ্ডা ও সরকারি গোয়েন্দারা করে থাকে। ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দমনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাঠে নামে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন।) প্রধানমন্ত্রী এসব বলে পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডাদের দমন-নির্যাতনকে ন্যায্য করছে। গত বছরও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ হলে আমও যাবে ছালাও যাবে। এমনকি বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর প্রায়শই বর্বরোচিত দমন-নির্যাতন চালানো হয়। অথচ শ্রমিক শোষক মালিকদের ফুলের টোকাও দেয়া হয় না।
দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার মালিকদের স্বার্থে খুন-জখম, হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার-নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। তাই শ্রমিক হত্যা-জখম-ক্ষয়ক্ষতির দায়ও মালিকপক্ষসহ ফ্যাসিবাদী হাসিনা-আওয়ামী সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের।
মজুরি বোর্ডের প্রতিনিধি কারা?
মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার কথা মালিক, শ্রমিক, নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদের নিয়ে। বরাবরই একজন বড় আমলা হন ‘নিরপেক্ষ’ প্রতিনিধি। এবার ‘নিরপেক্ষ’ প্রতিনিধি ছিলেন একজন বিচারপতি। ‘নিরপেক্ষ’ বিচারপতি মালিক পক্ষের স্বার্থই রক্ষা করে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজুরি বোর্ডে সত্যিকারের শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও কখনই স্থান পায় না। সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে শ্রমিক প্রতিনিধি করা হয়েছে। এই মজুরি বোর্ড নিশ্চিতভাবেই শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হবার কথা এবং হয়েছেও তাই। নামধারী শ্রমিক প্রতিনিধি ২০,৩৯৩ টাকা দাবি করলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে ১২,৫০০ টাকা মজুরিই চূড়ান্ত, ঘোষণার সাথে সাথেই তারা মেনে নিয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের মজুরি বোর্ড গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে তখন ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিল। ডলারের বিনিময় হার বিবেচনায় সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। বর্তমানে সরকার-নির্ধারিত ডলারের দাম বিবেচনায় নিলে বর্তমান বর্ধিত মজুরিও দাঁড়ায় মাত্র ১১৩ ডলারের মতো। তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অতি নগন্য। বাস্তবে ’১৮-সালের মজুরি বছরপ্রতি ৫% বৃদ্ধি পেয়ে এখন যা হয়েছে তার সাথে তুলনা করলে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি হয় নি বললেই চলে। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও বাৎসরিক ৫% বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিলে তথাকথিত মজুরি বৃদ্ধির এ জালিয়াতিটা সহজেই বোঝা সম্ভব। তার সাথে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধিকে হিসেব করা যায় তাহলে ‘মজুরি বৃদ্ধি’ সত্ত্বেও শ্রমিকদেরকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যেতে হবে।
বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১১৩ ডলার. ৩০৩ ডলার, ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার।
মালিকদের কি মজুরি বৃদ্ধির সক্ষমতা নেই?
মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মজুরি ১৪,৭৫০ টাকার বেশি দেবার সক্ষমতা নেই বলে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এই মজুরি দিতে না পেরে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাবে বলে দাবি করছে। অথচ বিপরীত দিকে গার্মেন্টস শিল্পে গত ১০ বছরেই (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল) তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। দেশের বস্ত্র ও তৈরি গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা তাদের বাড়তি অর্থ নতুন নতুন খাতেও বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে।
এছাড়া গার্মেন্টস মালিকরা অন্যান্য শিল্প-মালিকদের থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে সরকার থেকে। অন্যান্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে গার্মেন্ট মালিকদের করের হার ১০-১২ শতাংশ। এর বাইরে এই শিল্পের জন্য নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধাও আছে। সর্বোচ্চ বৈদেশিক রপ্তানি এবং সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধা পেয়েও শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মজুরি দিতে অনিচ্ছুক গার্মেন্টস মালিকরা। আর তাদের সাথে গলা মিলাচ্ছে হাসিনা সরকার।
সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আজকে শ্রমিক-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শ্রমিক দরদী সেজে শ্রমিক অধিকারের যে সব নীতিকথা বলছে তা শ্রমিকদের সাথে এক ভণ্ড প্রতারণা। গার্মেন্টস কারখানা হচ্ছে এই সাম্রাজ্যবাদীদেরই শিল্প। তারা নিজ দেশে শ্রমিক নিয়োগ করে এ শিল্প চালালে এতোটা মুনাফা করতে পারবে না। সেকারণেই তারা এখানে এই শিল্প গড়ে তুলেছে। তারা সহজেই শ্রমিকদের মজুরি আরো অনেক বাড়াতে পারে, যদি তারা মুনাফা কম করে এবং এদেশে তাদের দালালদেরকে একই কাজ করতে বাধ্য করে। কিন্তু তারা সেটা না করে উপরি উপরি শ্রমিক দরদী সাজে বাস্তবে সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের জন্য।
তাই গার্মেন্ট শিল্পের মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাম্রাজ্যবাদ, এনজিও, দালাল মালিক ও সরকারি প্রভাব মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে এবং সেজন্য সংগঠিত হতে হবে।
–১/১২/’২৩
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
গার্মেন্টস শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন
এখানেই থামবেন না
চাল-ডাল-তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের জুন মাস থেকে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে নামেন। তারা স্পষ্ট দাবি তুলেছিলেন ‘হয় দাম কমাও, নয়তো মজুরি বাড়াও’। ন্যূনতম মজুরি ৮,০০০ টাকায় এক পরিবারের দুইজনের আয়েও চলতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখনই তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম মজুরি ২৩/২৫ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলেই এ বছর এপ্রিলে সরকার ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ছয় মাসেও মজুরি বোর্ড কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায় শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভ জমতে থাকে। মেয়াদহীন মজুরি বোর্ড ২২ অক্টোবর মালিকদের স্বার্থে ন্যূনতম মজুরি মাত্র ১০,৪০০ টাকা প্রস্তাব করলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন।
শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও গুণ্ডাবাহিনী লেলিয়ে দেয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুঁড়ে শ্রমিক আন্দোলন ছত্র-ভঙ্গ করে। পুলিশ গুলি করে শ্রমিক হত্যা করলে শ্রমিক আন্দোলন আরও তীব্র হয় এবং গাজীপুর, আশুলিয়া, সাভার, মিরপুরসহ অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্রমিক আন্দোলন থামাতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে/পরামর্শে ৭ নভেম্বর’২৩ মজুরি বোর্ড ন্যূনতম মজুরি মাত্র ১২,৫০০ টাকা চূড়ান্ত করলে শ্রমিকরা তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গী আন্দোলন শুরু করেন। কাজ বন্ধ রেখে কারখানার সামনে বা মহাসড়কে জড়ো হয়ে ৪/৫ ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ ও আন্দোলন চালাতে থাকেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন-নির্যাতনে এবং শ্রমিক নেতা নামধারী সরকারি দালালদের ষড়যন্ত্রে শ্রমিক আন্দোলনের তীব্রতা কমে আসলেও প্রস্তাবিত মজুরি শ্রমিকরা মেনে নেননি।
আমাদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ‘গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ সহ ১১ সংগঠনের জোট "মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন" ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা প্রত্যাখ্যান করে। এই জোট ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে আঞ্চলিক সমাবেশ, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ মিছিলসহ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন অব্যাহত রেখেছে। শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে শ্রমিক ইমরান, রাসেল, আঞ্জুয়ারা বেগম ও জামালকে হত্যা করেছে। বিজিবি-র্যাব-পুলিশ মোতায়েন করে শ্রমিক এলাকাগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। শ্রমিক এলাকার প্রতিটি চায়ের টং-দোকান বন্ধ করে, চার/পাঁচ জন জড়ো হওয়া নিষিদ্ধ করে মূলত কারফিউ জারি করে। ৪৩ মামলায় ২০ হাজার শ্রমিককে আসামী করে শ্রমিক নেতা বাবুল হোসেনসহ এ পর্যন্ত ১১৫ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করে। শ্রমিক আন্দোলন বন্ধ করতে মালিক পক্ষের আওয়ামী গুন্ডারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শ্রমিক নেতাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। মালিকরা ১৩৬টি কারখানা বন্ধ করেছিলো। এখন শ্রমিক নেতাদের ছাঁটাই করতে কালো তালিকা প্রস্তুত করছে।
৪ জন শ্রমিক হত্যা ও অগণিত জখমের দায় কার?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের দাবির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দাবিকৃত মজুরির অর্ধেকে সন্তুষ্ট থেকে কাজে ফিরে যাওয়ার নসিহত করেছে। হুমকি দিয়ে বলেছে আন্দোলন বন্ধ না করলে শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে কোনো মহলের উস্কানি বলে আখ্যায়িত করে বলেছে যারা তোমাদের উস্কানি দিবে তারাই তোমাদের লাশ ফেলে দিবে। (যেমনটা আওয়ামী গুণ্ডা ও সরকারি গোয়েন্দারা করে থাকে। ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দমনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মাঠে নামে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ নেতা আওলাদ হোসেন।) প্রধানমন্ত্রী এসব বলে পুলিশ ও আওয়ামী গুন্ডাদের দমন-নির্যাতনকে ন্যায্য করছে। গত বছরও মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ হলে আমও যাবে ছালাও যাবে। এমনকি বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর প্রায়শই বর্বরোচিত দমন-নির্যাতন চালানো হয়। অথচ শ্রমিক শোষক মালিকদের ফুলের টোকাও দেয়া হয় না।
দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার মালিকদের স্বার্থে খুন-জখম, হামলা-মামলা-গ্রেপ্তার-নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। তাই শ্রমিক হত্যা-জখম-ক্ষয়ক্ষতির দায়ও মালিকপক্ষসহ ফ্যাসিবাদী হাসিনা-আওয়ামী সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের।
মজুরি বোর্ডের প্রতিনিধি কারা?
মজুরি বোর্ড গঠিত হওয়ার কথা মালিক, শ্রমিক, নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদের নিয়ে। বরাবরই একজন বড় আমলা হন ‘নিরপেক্ষ’ প্রতিনিধি। এবার ‘নিরপেক্ষ’ প্রতিনিধি ছিলেন একজন বিচারপতি। ‘নিরপেক্ষ’ বিচারপতি মালিক পক্ষের স্বার্থই রক্ষা করে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মজুরি বোর্ডে সত্যিকারের শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও কখনই স্থান পায় না। সরকার দলীয় শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলামকে শ্রমিক প্রতিনিধি করা হয়েছে। এই মজুরি বোর্ড নিশ্চিতভাবেই শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হবার কথা এবং হয়েছেও তাই। নামধারী শ্রমিক প্রতিনিধি ২০,৩৯৩ টাকা দাবি করলেও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে ১২,৫০০ টাকা মজুরিই চূড়ান্ত, ঘোষণার সাথে সাথেই তারা মেনে নিয়েছে।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের মজুরি বোর্ড গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনে বাধ্য হয়ে তখন ৮ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিল। ডলারের বিনিময় হার বিবেচনায় সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। বর্তমানে সরকার-নির্ধারিত ডলারের দাম বিবেচনায় নিলে বর্তমান বর্ধিত মজুরিও দাঁড়ায় মাত্র ১১৩ ডলারের মতো। তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অতি নগন্য। বাস্তবে ’১৮-সালের মজুরি বছরপ্রতি ৫% বৃদ্ধি পেয়ে এখন যা হয়েছে তার সাথে তুলনা করলে প্রকৃত বেতন বৃদ্ধি হয় নি বললেই চলে। ডলারের দাম বৃদ্ধি ও বাৎসরিক ৫% বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিলে তথাকথিত মজুরি বৃদ্ধির এ জালিয়াতিটা সহজেই বোঝা সম্ভব। তার সাথে যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধিকে হিসেব করা যায় তাহলে ‘মজুরি বৃদ্ধি’ সত্ত্বেও শ্রমিকদেরকে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যেতে হবে।
বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১১৩ ডলার. ৩০৩ ডলার, ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার।
মালিকদের কি মজুরি বৃদ্ধির সক্ষমতা নেই?
মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মজুরি ১৪,৭৫০ টাকার বেশি দেবার সক্ষমতা নেই বলে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এই মজুরি দিতে না পেরে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাবে বলে দাবি করছে। অথচ বিপরীত দিকে গার্মেন্টস শিল্পে গত ১০ বছরেই (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল) তৈরি পোশাকের রপ্তানি আয় ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। দেশের বস্ত্র ও তৈরি গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা তাদের বাড়তি অর্থ নতুন নতুন খাতেও বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে।
এছাড়া গার্মেন্টস মালিকরা অন্যান্য শিল্প-মালিকদের থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে সরকার থেকে। অন্যান্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে গার্মেন্ট মালিকদের করের হার ১০-১২ শতাংশ। এর বাইরে এই শিল্পের জন্য নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধাও আছে। সর্বোচ্চ বৈদেশিক রপ্তানি এবং সর্বোচ্চ সরকারি সুবিধা পেয়েও শ্রমিকদের দাবি অনুযায়ী মজুরি দিতে অনিচ্ছুক গার্মেন্টস মালিকরা। আর তাদের সাথে গলা মিলাচ্ছে হাসিনা সরকার।
সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আজকে শ্রমিক-আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শ্রমিক দরদী সেজে শ্রমিক অধিকারের যে সব নীতিকথা বলছে তা শ্রমিকদের সাথে এক ভণ্ড প্রতারণা। গার্মেন্টস কারখানা হচ্ছে এই সাম্রাজ্যবাদীদেরই শিল্প। তারা নিজ দেশে শ্রমিক নিয়োগ করে এ শিল্প চালালে এতোটা মুনাফা করতে পারবে না। সেকারণেই তারা এখানে এই শিল্প গড়ে তুলেছে। তারা সহজেই শ্রমিকদের মজুরি আরো অনেক বাড়াতে পারে, যদি তারা মুনাফা কম করে এবং এদেশে তাদের দালালদেরকে একই কাজ করতে বাধ্য করে। কিন্তু তারা সেটা না করে উপরি উপরি শ্রমিক দরদী সাজে বাস্তবে সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের জন্য।
তাই গার্মেন্ট শিল্পের মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাম্রাজ্যবাদ, এনজিও, দালাল মালিক ও সরকারি প্রভাব মুক্ত ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে এবং সেজন্য সংগঠিত হতে হবে।
–১/১২/’২৩
আরও খবর
- শনি
 - রোব
 - সোম
 - মঙ্গল
 - বুধ
 - বৃহ
 - শুক্র